সতের বছর বয়সী জামিলা সাতাশ বছর বয়সী যুবক জামিলের সাথে ঘর ছাড়েন। অনেক স্বপ্নসাধ নিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তান জামিলের উপর আস্থা রেখেছিলেন। ভালো বাসার মোহ কেটে গেলে জামিল জামিলাকে টাঙ্গাইলের যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জামিলা মানব জাতির আদিম পেশায় নিযুক্ত হয়। প্রতিনিয়ত নানা রকম মানুষের সানি্নধ্যে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। কামাতুর পুরুষের কথাবার্তা, আচার-আচরণ প্রায় একই রকম।
একদিন এক যুবক তার ঘরে এসে হাজির। তাকে দেখে জামিলার বুকটা কেঁপে উঠলো। এমন খদ্দের এর আগে আর কোনোদিন দেখেনি। চেহারায়, আচরণে, কথাবার্তায় জামিলা মুগ্ধ। যুবক বিছানায় শুয়ে জামিলাকে মাথা টিপে দিতে বললো। মাথায় হাত রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যে যুবকটি ঘুমিয়ে পড়লো। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। জামিলা দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নাই। ঘণ্টা দুয়েকের টানা বৃষ্টি সন্ধ্যায় থামলো। যুবক ঘুম থেকে জেগে জামিলাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কী?
-আমার নাম জামিলা।
-যুবকটি বললো, আমার নাম কামাল। শহরে থাকি।
পকেটে থেকে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে দিয়ে বললো, টাকাটা রাখো।
-কাজ ছাড়া আপনি টাকা দেন কেনো?
-আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই দিলাম।
জামিলা টাকাটা বুকের মধ্যে রেখে যুবকের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। আগে কোনো দিন কেউ একশ' টাকার বেশি দেয়নি। কাজ ছাড়া পাঁচশ' টাকা পেয়ে হিসাব মিলাতে পারছেন না। প্রায় প্রতিদিন কামাল জামিলার ঘরে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে যায়। কামাল জামিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। জামিলা কোনো মতেই রাজি হচ্ছে না। কামাল আত্মহত্যার হুমকি দিলে জামিলা বিয়েতে রাজি হয়। সকল সমালোচনা ঘৃণা উপেক্ষা করে কামাল জামিলা সংসার পাতলো। কামালের পরিবারের লোকেরা তাকে ইটালি পাঠানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শেষ পর্যন্ত কামাল ইটালি পাড়ি দিলো। জামিলাকে কথা দিয়েছিল যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ইটালি নিয়ে যাবে। কামাল ইটালি যাবার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। জামিলাকে ফিরে যেতে হলো পুরানো কর্মস্থলে। খালা অনেক বকাবকি করে আশ্রয় দিলো। তিনি পেটের বাচ্চা ফেলে দেবার জন্যে চাপ দিলেন। জামিলা কিছুতেই রাজি হলো না।
খালাকে বললো, কয়েক মাস পর বাচ্চাটার মুখ দেখে হোমে দিয়ে দিবো। খালা ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলো। সদর হাসপাতালে জামিলা পুত্রসন্তানের জন্ম দিলো।
নিঃসন্তান ডাক্তারের দত্তক নেবার আবেদনে রাজি হননি। চারদিন পর নবজাতককে কোলে করে যৌনপল্লীতে ফিরে আসলেন। খালা শিশুটির সেবা-যত্নে আত্মনিয়োগ করলেন।
শিশুটির নাম রাখা হলো সুরুজ। সুরুজকে নিয়ে নানীর সারাদিন কাটে। ছয় বছরের সুরুজকে সোনার বাংলা সেফ হোমে ভর্তি করা হলো।
রোজগার কম, নির্যাতন বেশি হওয়ায় জামিলা খালাকে নিয়ে যৌনপল্লী ছেড়ে আলাদা বাসা নিয়েছেন। সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। মেধাবী সুরুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সম্মানজনক চাকরি পেলো। মা এবং নানীকে নিয়ে নতুন সংসার শুরু করলো। সুরুজ বিয়ে করলো সহপাঠী মিলিকে। মিলি সুরুজের পরিবারের সব ঘটনা জানতো।
সুরুজের নানী খবর পেলো গাজীপুর বৃদ্ধাশ্রমে তার দুজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী থাকছেন। সুরুজের নানীর মনটা উতলা হয়ে উঠলো যাবার জন্যে। নাতিকে বললো, 'ভাই সুরুজ আমাকে তুই গাজীপুর বৃদ্ধাশ্রমে একদিন নিয়ে চল। সেখানে আমার দুই বান্ধবী থাকেন। তারা জনম দুঃখী। সারাজীবনে সুখ দেখলো না। তুই তো আমার জীবনটা সার্থক করে দিলি।'
এক শুক্রবার মাইক্রোবাসে পরিবারের সবাই বৃদ্ধাশ্রমে আসলো। সুরুজের নানী দুই বৃদ্ধাকে পেয়ে কেঁদে কেটে অস্থির। গল্প আর কোনো মতেই থামছে না। বৃদ্ধাদের একজন বললো, 'এই জামিলা! কামাল তো এইখানে থাকে! আমাদের সাথে প্রায়ই দেখা হয়। ধন সম্পদ রূপ যৌবন শেষ করে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে।'
জামিলা ছেলেকে নিয়ে পুরুষদের থাকার ঘরে গেলো। কামালকে দেখিয়ে বললো, ইনি তোমার বাবা।
কামাল জামিলাকে মুহূর্তে চিনতে পারলেন। ছেলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। কামালের সংসারের খোঁজখবর নিয়ে ফিরে গেলেন জামিলা। পুরো সময়টাতে একবারও কথা বলেনি সুরুজ।
গাড়িতে সুরুজের নানী বলেছিলো, 'কামালের বিচার দুনিয়াতে দেখলাম। আল্লাহর মাইর, দুনিয়ার বাইর'।
গাড়িতে কেউ কোনো কথা বললো না। অফিসের কাজে দেশের বাইরে দশদিন কাটিয়ে সুরুজ বাসায় ফিরলো। রাতে সুরুজ মা কে বললো, 'আগামীকাল সকালে বাবাকে আনতে যেতে চাই। বাবার জীবনের শেষ ক'টা দিন নিজের হাতে সেবা করতে চাই। তুমি অনুমতি দাও মা!' জামিলা চোখের পানি মুছে ছেলেকে অনুমতি দিলো।
পরদিনই সকালে মিলি আর সুরুজ গাড়ি নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পেঁৗছে গেলো। বাবার সামনে হাজির হয়ে বললো, 'আমি তোমাকে নিতে এসেছি।'
কামাল সাহেব ছেলেকে বললেন, 'তোমার মায়ের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি আমার নাই। আমি যাবো না তোমার সাথে। জীবনের শেষ ক'টা দিন আমি এখানেই প্রায়শ্চিত্ত করবো।' বাবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছে।
সুরুজ বাবাকে বললো, 'আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?'
কামাল সাহেব বললেন, 'আমি মরে গেলে আমাকে মা-বাবার পাশে কবর দিও। আমি বড় ভীতু বাবা! আমাকে তুমি নিজের হাতে কবরে রেখে এসো। একটা সাইনবোর্ড কবরের পাশে দিও। যেখানে লেখা থাকবে -এক গাদ্দার এখানে শুয়ে আছে।'
.
বীরাঙ্গনা
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাদারীপুর ক্যাম্প থেকে আশপাশের এলাকায় হামলা চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতো। একদিনে শরিয়তপুরের মধ্য পড়ায় তিনশ' মানুষকে হত্যা করে। শরিয়তপুরে বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময় টাকা-পয়সা সোনা-গয়না নিয়ে যেত। যেসব নারীকে পছন্দ হতো তাদেরকে মাদারীপুর ক্যাম্পে নিয়ে আসতো। সুমিত্রা, যোগমায়া, যুগলবালাসহ অনেক নারী পাকবাহিনীর হাতে নির্যাতিতা। এই তিনজনকে শহরের একই পাড়া থেকে নিয়ে যায়। তিন সন্তানের জননী সুমিত্রা মালোর বয়স তখন পঁয়ত্রিশ বছর।
স্বাধীন দেশে বিজয়ের পতাকা হাতে মুক্তি বাহিনীর আগমনে ক্যাম্প থেকে সুমিত্রাসহ অন্যরা মুক্তি পেলেন। সন্তানরা মাকে পেয়ে বেজায় খুশি। স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে স্বামী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বড় সংসারে সবার মুখে ভাত জোটানোর লড়াই জারি রাখতে সুমিত্রা স্বামীর সহযাত্রী হলেন। দিন রাত সীমাহীন খাটুনি করে শান্তি স্বস্তির দেখা মিলে না। সুমিত্রা পর পর তিন সন্তান জন্ম দিলেন। কাউকে বাঁচাতে পারলেন না। অবশেষে চতুর্থ সন্তান
মেয়ে জন্ম নিল। নাম রাখলেন জয়িতা। জয়িতা কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। যুদ্ধের আগে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়েরা অভাব-অনটন আর পুষ্টিহীনতায় ভুগে শারীরিক মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিল। তাদের টিকে থাকার লড়াই যেকোন সময়ে থেমে যাবার সম্ভাবনা ছিল। সেই আশংকাই সত্যি হয়েছিল সুমিত্রার জীবনে। প্রথমে ছেলে পরে মেয়েকে হারিয়ে জীবনকে নতুন করে পেলেন। একসময়ে জীবন যুদ্ধের লড়াকু সহযোদ্ধা স্বামীটিও চলে গেলেন। বেঁচে থাকা মেজো মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন, কিন্তু মুক্তি মিলেনি। অসুখ বিসুখ আর স্বজন হারানোর শোকে সুমিত্রার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। শারীরিক পরিশ্রমের কাজ আর করতে পারেন না। জয়িতার পড়াশোনা, সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাওয়া সুমিত্রা টিউশনি শুরু করলেন। গরিব ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সুযোগ পেলেন, যারা ঠিকমত টাকা দিতে পারে না। তবুও বেঁচে থাকার একটা উপায় হলো।
অনেক দিন পর জয়িতার মাথার চুলে তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন সুমিত্রা। জয়িতা সামনের সুপারির বাগানের দিকে তাকিয়ে মা কে জিজ্ঞেস করলেন, 'মা আমরা কেন এত গরিব হলাম? আমাদের অভাব যায় না কেন? একটা ভাঙ্গা চুরা ঘরেই জীবন কাটিয়ে দিব?'
সুমিত্রা চুপ করে আছে অনেকক্ষণ। মেয়ে তাড়া দিল,
কথা বলছো না কেন মা?
সুমিত্রা-কী বলবো? পরিশ্রমে ধন আনলে আমাদের ধন সম্পদের জন্য এত হাহাকার করতে হবে কেন?
জয়িতা-তবে কী করলে ধনী হওয়া যাবে?
সুমিত্রা-ভালো করে লেখাপড়া করো, তবেই ভাগ্য ফিরবে, ধনী হবে। বাসাবাড়িতে, ক্ষেতে খামারে, কলে-কারখানায় কামলা দিলে ভাতের দুঃখ থেকে রেহাই মিলবে না।
জয়িতা চুপ করে থাকে। লেখাপড়ায় তেমন ভালো না, তাই মাকে আশ্বস্ত করতে পারলো না।
শিশু-কিশোররা পাঠ্যপুস্তকে মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস যখন পড়ে তখন বেশিরভাগ সময়ে সুমিত্রা চোখ বন্ধ করে শোনেন।
শিশুরা পড়ে, '১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি এক রক্তক্ষয়ী মরণপণ লড়াই শুরু করে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত আর দু'লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি।'
এই কথা যতবার শোনেন ততবারই পাক আর্মি ক্যাম্পের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা চোখের সামনে ভেসে উঠে।।
স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে জেলা প্রশাসনের আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সুমিত্রা সহ চার বীরাঙ্গনা নিমন্ত্রণ পান। জেলা প্রশাসকের হাত থেকে উপহার সামগ্রী গ্রহণ করেন।
সাংবাদিক, গবেষকরা মাঝেমধ্যে এসে শুনতে চান।
ঘটনার বর্ণনা দিতে কান্নায় বুক ফেটে যায়, তবু বলার জন্য আকুল থাকেন।
একবার এক সাংবাদিক জানতে চান,"দেশের জন্য অনেক বহু ত্যাগ করেছেন, এখন সরকারের কাছে কী চান?'
সুমিত্রা-একটা চাকরি চাই।
সাংবাদিক-আপনি একজন অসুস্থ প্রবীণ। তদুপরি লেখাপড়া অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কী চাকরি করবেন?
সুমিত্রা-স্কুলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবো। কত রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেলাম তা বলবো। মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস শিশু-কিশোরদের সামনে আসলে ওরা দেশটার মূল্য বুঝতে পারবে। দেশটাকে ভালো বাসবে, রক্ষা করবে।
সুমিত্রার বয়স যখন পঁচাত্তর বছর তখন তিনি শুনতে পেলেন সরকার বীরাঙ্গনাদের ভাতা দিবেন।
স্থানীয় প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধারা সুমিত্রাকে বীরাঙ্গনাদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেন।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে পার করেছেন। মনে মনে ভাবতেন জয়িতার যদি একটা সরকারি চাকরি হতো! আশা নিরাশার দোলাচালে থেকে সুমিত্রা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
সুমিত্রার দুই মেয়ে ভাগাভাগি করে বীরাঙ্গনা ভাতা পান। প্রতিমাসে মোবাইলে ভাতা আসার মেসেজ পড়ে জয়িতার চোখে পানি আসে।
.
কোভিড-১৯
আজিজ সাহেবের ছিয়াত্তরতম জন্মদিনে ছেলেমেয়েরা একত্রিত হয়েছে। হৈ চৈ, গল্পগুজবে উত্তরার বাড়িটা জমে উঠেছে। নাতি-নাতনিরা খেলাধুলা, শপিং, খাওয়া-দাওয়া, ছুটোছুটি, মান অভিমানে মেতেছে। বছর পাঁচেক আগে আজিজ সাহেব স্ট্রোক করেছিলেন। একা একা দূরে কোথাও যেতে সাহস পান না। হাঁটু ও কোমর ব্যথায় স্ত্রীর চলাচল সীমিত।
আজিজ সাহেব সকালে বারান্দায় বসে দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলেন। চীনের উহান থেকে বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ বিমান চীন যাচ্ছে। এমন সংবাদ তাকে বিচলিত করে তুললো।
তিনি ছোট মেয়ে রোজীকে ডাকলেন।
-রোজী, কোভিড-১৯ বাংলাদেশে ছড়ানোর সম্ভাবনা কতটুকু?
-আব্বু অতীতে ইবোলা, মার্স, নিপা, বস্নাড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু বিভিন্ন দেশকে বড় রকমের বিপদে ফেলেছে, কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কিছু হয়নি।
-ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে এই ছোঁয়াচে রোগে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে।
-তুমি কেন এসব বিষয় নিয়ে সিরিয়াস হচ্ছো?
-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারি শুনছো না?
-ওরাতো আটানব্বইয়ের বন্যায় লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করেছিল।
-এবারের কোভিড-১৯ বোধহয় অন্য রকম হবে!
-নাস্তা খেতে চলো আব্বু। সবাই তোমার অপেক্ষা করছে।
ক'দিনের মধ্যে আজিজ সাহেবের ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেল। আবার সেই শূন্য বাসা! শূন্য বাসা কেন? দুজন গৃহকর্মী, ড্রাইভার, কেয়ারটেকার, দারোয়ানসহ পাঁচজন। কিন্তু তারা তো রক্তের সম্পর্কিত কেউ না! রক্তীয়রা তো ব্যস্ত! এসব ভাবনা আজিজ সাহেবের চিন্তার আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে তোলে।
সারা দুনিয়ায় কোভিড-১৯-এর আক্রমণ ভয়াবহ হলো। বাংলাদেশে লকডাউনে জনজীবন স্থবির হয়ে গেল। কতজনকে পরীক্ষা করা হয়েছে, কতজন মরলো, মৃতের লাশ স্বজনরা নিচ্ছে না, হাসপাতালে চিকিৎসা নেই এই সংবাদ দেখে দেখে দিন গুজরান হচ্ছে।
আজিজ সাহেবের স্ত্রী নিলুফার জ্বর-হাঁচি-কাশি চার দিন ধরে। টেলিফোনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাচ্ছেন। নিলুফার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। তার কোভিড-১৯ পজিটিভ। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে অঙ্েিজন অতঃপর আইসিইউতে স্থানান্তর। আজিজ সাহেব সকল রকমের ভয় ভীতি উপেক্ষা করে ৫০বছরের দাম্পত্য সঙ্গীর সাথে থাকলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর সময় হাতখানি ধরে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন-কাফনের কাজ শেষ হলো। বাসায় ফিরে দশদিন পর গরম পানিতে গোসল করলেন। খাবার টেবিলে বসে বুঝতে পারলেন তার ঘ্রাণশক্তি নাই। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠলো। রাতেই জ্বর আসলো। সকালে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কেয়ারটেকার মঈনুল গৃহকর্মী রাণী পালাক্রমে সার্বক্ষণিক আজিজ সাহেবের সেবা-যত্নে নিয়োজিত থাকলেন। প্রায় মাসখানেক চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে উত্তরার বাসায় উঠলেন। বাড়িটার প্রতিটি নির্মাণ সামগ্রীর সাথে এক ধরনের সম্পর্ক আছে। কত দিনরাত্রি বাড়ি বানানোর কাজে ব্যয় করেছেন তা মনে করে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেন।
শরীর খুবই দুর্বল, হুইল চেয়ার ছাড়া চলতে ফিরতে পারেন না। স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি কারো সাথে ফোনে কথা বলেন না। তার ফোন মঈনুল কিংবা রাণী ধরেন।
আজিজ সাহেবের শুধু মাকে মনে পড়ে। মা বলতেন, দশ ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছি একহাতে, আজ আমি একজন মানুষ দশজনের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম। তোমরা উচ্চ শিক্ষিত বলে মানুষ আমার ঝুলির প্রশংসা করে। তবে আমার মনে হয় দু-একটা কম শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে থাকলে আমি তাদের সাথে থাকতে পারতাম।
হুইল চেয়ারে বসে আজিজ সাহেব মায়ের কথা মনে করে চোখের পানিতে ভাসছেন।
রাণী টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বললেন, খালু আপনি এতো কান্দেন ক্যান? দুনিয়াডা কিছু না, একটা মায়া! আমরা তো আপনার রক্তের কেউ না। এতবছর আপনার নুন, নিমক খাইছি, তাই বিপদের সময় পালাইতে পারলাম না।
মঈনুল বাজারের ফর্দ নিয়ে হাজির হলেন। রাণী আলমিরা থেকে টাকা বের করে দিলেন। রাণী বুঝতে পারলেন আজিজ সাহেবের ডায়াপার বদলাতে হবে।
মঈনুলের সাহায্যে ডায়াপার বদলে দিলেন। বিছানা গুছিয়ে মঈনুল আজিজ সাহেবকে বিছানায় তুলে দিলেন। আজিজ সাহেব মঈনুলের মাথাটা মুখের কাছে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন।
মঈনুল চিৎকার করে কেঁদে ওঠে বললেন, আপনি আমাদের এত আদর করেন কেন?
মঈনুলের কান্না মুহূর্তে সংক্রমিত হয়ে গেল। রাণী, মরিয়ম, ড্রাইভার, দারোয়ান পাঁচজন মিলে বিলাপ করে কাঁদতে থাকলেন। পড়শীরা বুঝতে পারলো আজিজ সাহেব মারা গেছেন।
.
বিয়ে বিনোদন
গত ষাট বছর ধরে মাসুদ হাজী ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে যুক্ত আছেন। কাজ শুরু করেছিলেন দোকান কর্মচারী হিসেবে। এখন তিনি দশটি দোকানের মালিক। সারাদেশে পাইকারী বিক্রি করেন। গাড়ি বাড়ি সহায় সম্পদ হয়েছে। দান খয়রাতে বেশ নাম করেছেন। ছেলের আশায় দশটি মেয়ের বাবা হয়েছেন। তিনি নিয়তির উপর নির্ভর করেন। স্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন ছেলে হলে এতদিনে হয়ে যেত। স্ত্রী নিয়তি মেনে নিতে পারেন নি, তাই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
বরাবরই একই ফল পেয়েছেন। মাসুদ হাজী স্ত্রীকে ঠাট্টা করে বলেন, তুমি হলে গিয়ে গার্লস স্কুলের বাস। এখান থেকে শুধু মেয়েরাই নামবে। আমি ধনী হলাম মেয়েদের ভাগ্যে। বেহেশতে যাবো এতোগুলো মেয়ের দোয়ায়।
স্ত্রী সফুরাকে পুত্রের জন্য হাহাকার করতে দেখে মাসুদ হাজীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। মাসুদ হাজীরা আট ভাই দুই বোন ছিল। সন্তান লালনপালনে অভাবের সংসারে বাবা-মার দুঃখ কষ্ট চোখের সামনে ভাসে। শুধু দুবেলা খাবারের বিনিময়ে মাসুদ হাজী দোকানের কর্মচারী হয়েছিল।
মাসুদ হাজীর স্ত্রী অাঁতুড়ঘর, হাসপাতাল, ভরাপেট, শিশু পালনে জীবন কাটিয়ে দিলেন। যেন সন্তান উৎপাদনের কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।
মাসুদ হাজী প্রতিমাসে সাতদিন ঢাকার বাইরে ব্যবসায়িক কাজে থাকেন। এই সময়ে মোবাইল বন্ধ রাখেন। এটা পরিবারের কেউ মানতে চান না। সফুরা মোবাইল খোলা রাখার অনুরোধ করেছে অথবা ফোন করে ভালো আছে এটুকু সংবাদ অন্তত একবার দেয়। মাসুদ হাজী এসব পাত্তা দেয় নি।
কানাঘুষা চলছে মাসুদ হাজীর বিভিন্ন জেলায় স্ত্রী রয়েছে। স্ত্রী সফুরার কাছে এসব কথা আসে। তিনি তথ্য প্রদানকারীকে বলেন, বিয়ে করা কি খারাপ? নাকি লুচ্চামি করা খারাপ? তিনি আমার ভরণপোষণ দেন। আমার নামে বাড়ি গাড়ি করে দিয়েছেন। মাসুদ হাজী কী করে না করে সেই খবর দেয়ার জন্য আপনার এত গরজ কেন? অভিযোগকারীরা হতাশ হয়ে ফিরে যায়।
অন্য ব্যবসায়ীরা মাসুদ হাজীকে ঠাট্টা মসকরা করে বলে, হাজী সাব! এখন কয় নাম্বার চলতেছে? আমাগো কথা কিছু ভাইবেন!!
মাসুদ হাজী এসব ঠাট্টা মসকরা গায়ে মাখেন না। তিন সপ্তাহ ঢাকা বাকি এক সপ্তাহ ঢাকার বাইরে এ নিয়মের কোনো নড়চড় হয় না।
ছিদ্রান্বেষক ও গবেষকরা খোঁজ খবর করে জানালেন, মাসুদ হাজী বিভিন্ন জেলার তুলনামূলক দরিদ্র এলাকায় বিয়ে করে কিছু দিন সংসার করেন। আশপাশের দরিদ্র মানুষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান খয়রাত করেন। যে বাড়িতে বিয়ে করেন তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি দৃশ্যমান হয়ে উঠে। সবজায়গায় মাসুদ হাজীর জয়জয়কার!
কোভিড-১৯ মাসুদ হাজীকে লকডাউনে আটকে ফেলে। মাস তিনেক পর পরিবারের সদস্যদের কড়াকড়ি উপেক্ষা করে তিনি তার মফস্বলের স্ত্রীদের সাথে দেখা করতে চলে গেলেন।
প্রায় ছ'মাস ধরে মফস্বলের স্ত্রীদের সাথে কাটিয়ে অসুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। জ্বর, পাতলা পায়খানা, কাশি কাবু করে ফেলেছে। আসগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কোভিড-১৯ টেস্ট নেগেটিভ কয়েকবার। মাসাধিক কাল চিকিৎসা শেষে খুবই দুর্বল শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলেন।
সবার মুখের দিকে তাকিয়ে, আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারছেন তিনি আর বেশি দিন নাই। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন এত টাকা পয়সা ধনসম্পদ কেন অর্জন করেছেন! জীবনের এতগুলো বছর কেন গাধার খাটুনি খাটলেন। সব কিছু রেখে যেতে হবে এটা সবাই জানে। মরার ঠিক আগ মুহূর্তে এই উপলব্ধি-বিবেচনা দারুণ!
সাবরেজিস্ট্রার অফিস থেকে কমিশন আসলো। সবকিছু লিখে দিলেন দশ মেয়ে ও স্ত্রীর নামে। সন্তানরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো!
ফজর | ৪:২২ |
যোহর | ১২:০০ |
আসর | ৪:৩১ |
মাগরিব | ৬:২২ |
এশা | ৭:৩৭ |
হেরার আলো
|
বাণী চিরন্তন
|
আল-হাদিস
|
৯৮-সূরা বায়্যিনাঃ ০৮ আয়াত, ১ রুকু, মাদানী পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। ৭। যাহারা ঈমান আনে ও সংকর্ম করে, তাহারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। ৮। তাহাদের প্রতিপালকের নিকট আছে তাহাদের পুরস্কার-স্থায়ী জান্নাত, যাহার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তাহারা চিরস্থায়ী হইবে। আল্লাহ তাহাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তাহারাও তাঁহাতে সন্তুষ্ট। ইহা তাহার জন্য, যে তাহার প্রতিপালককে ভয় করে।
সৌভাগ্য এবং প্রেম নির্ভীকের সঙ্গত্যাগ করে। _ওভিড।
নিরপেক্ষ লোকের দোয়া সহজে কবুল হয়।
|
করোনা পরিস্থিতি | ||
বাংলাদেশ | বিশ্ব | |
আক্রান্ত | ৬,৪৪,৪৩৯ | ১৩,২১,৯৪,৪৪৭ |
সুস্থ | ৫,৫৫,৪১৪ | ১০,৬৪,২৬,৮২২ |
মৃত্যু | ৯,৩১৮ | ২৮,৬৯,৩৬৯ |
দেশ | ২১৩ | |
সূত্র: আইইডিসিআর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। |
হ্যাঁ | না | মতামত নেই |